মহামহিম আল্লাহ তা‘য়ালা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য। পৃথিবীতে মানুষকে প্রেরণ করেছেন তাঁর খলীফা বা প্রতিনিধি হিসেবে। আমরা যদি দুনিয়ার জীবনকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারি ও মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি তাহলেই কেবল পরকালীন জীবনে রয়েছে সফলতা। তাই দুনিয়ার জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হলো ‘ঈমান’ তথা আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস। ‘ঈমান’ ছাড়া একজন ব্যক্তির যত ভালো কাজই হোক না কেন তা গ্রহণীয় হবে না। নিম্নের আর্টিকলে আমরা ঈমানের পরিচয়, গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানব ইন শা আল্লাহ।
ঈমানের পরিচয়
ঈমানের শাব্দিক অর্থ, আশঙ্কামুক্ত করা, নিরাপত্তা দেওয়া। আরেক অর্থে, বিশ্বাস, আস্থা, অনুগত হওয়া ইত্যাদি। [আল ক্বামুসুল মুহীত] প্রথম অর্থে হৃদয়কে সকল প্রকার গাইরুল্লাহর বিশ্বাস থেকে মুক্ত করা ও একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্যকিছু থেকে হৃদয়কে নিরাপত্তা দেয়া ‘ঈমান’।
পরিভাষায়: পারিভাষিক অর্থে ঈমান হলো, মূল ও শাখাসহ হৃদয়ে বিশ্বাস করা, মুখে স্বীকৃতি দেয়া ও সেসব কর্মে বাস্তবায়নের নাম। প্রথম দুটি অর্থাৎ অন্তরে বিশ্বাসের সাথে সাথে মুখে স্বীকৃতি দেয়া মূল আর শেষেরটি হলো শাখা। যা না করলে পূর্ণ মুমীন হওয়া যায় না। ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মতে, ‘আন্তরিক বিশ্বাস ও মৌখিক স্বীকৃতিই হলো ঈমান।’ ইমাম শাফেয়ী, মালিক ও আহমাদ রহ. এর মতে, ‘অন্তরের বিশ্বাস, মৌখিক স্বীকৃতি এবং ইসলামের বিধিবিধানসমূহ কাজে পরিণত করার নাম ঈমান।
তিনটি বিষয়ের সমষ্টির নাম ঈমান
তিনটি বিষয়ের সমন্বিত রূপ হলো ‘ঈমান’। সে তিনটি হলো:
১. تَصْدِيقٌ بِالْجَنَانِ (অন্তর দিয়ে বিশ্বাস): প্রথমেই অন্তর দিয়ে দৃঢ় বিশ্বাস করতে হবে।
২. إِقْرَارٌ بِاللِّسَانِ (মৌখিক উচ্চারণ): অন্তর দিয়ে বিশ্বাসের পাশাপাশি মুখে উচ্চারণ করতে হবে।
৩. عَمَلٌ بِالْأَرْكَانِ (কর্মে বাস্তবায়ন করা): মুখে উচ্চারণ ও বিশ্বাসের পর ইসলামের সকল বিধিবিধান কর্ম বা আমলের দ্বারা বাস্তবায়ন করতে হবে।
কোনো ব্যক্তি অন্তরে বিশ্বাস করলো কিন্তু মুখে কালিমা শাহাদাহ উচ্চারণ করলো না সে মুমীন হতে পারে না। একইভাবে মুখে উচ্চারণ করে বললেও অন্তরে বিশ্বাস রাখছে না সেটাও ঈমান বলে গণ্য হবে না। অন্তরের বিশ্বাসের পাশাপাশি ইসলামের বিধিনিষেধসমূহ কর্মে বাস্তবায়নের মাধ্যমে ঈমানের পরিচয় দিতে হবে। সুতরাং, এই তিনটি বিষয়ের সমষ্টির নাম হলো ‘ঈমান’।
ঈমানের গুরুত্ব
ঈমান হলো পার্থিব জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ঈমানহীন সকল ভালো কর্ম পরিত্যাজ্য বলে বিবেচিত হবে। একটি ‘শূন্য’ অসংখ্যবার লেখলে ভিন্নভাবে হয়ত কোনো মূল্য নেই। কিন্তু একের পর যত শূন্য লেখা হবে তত সংখ্যার মান বৃদ্ধি পাবে। ঠিক তেমনি, ঈমান হলো যে কোনো নেক কর্মের পূর্বশর্ত। যে কোনো আমল গ্রহণযোগ্যতার পূর্বশর্ত হলো ‘ঈমান’। দুনিয়াতে ঈমানহীন জীবনের কোনো মূল্য নেই।
ইসলামের মৌলিক স্তম্ভ ‘ঈমান’
ইসলামের প্রথম স্তম্ভ বা রুকন হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনা। নবী সা. ইরশাদ করেন-
” ” بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالْحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ
‘ইসলামের স্তম্ভ হলো পাঁচটি, ১. আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সা. আল্লাহর রাসূল এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া, ২. সালাত কায়েম করা, ৩. যাকাত প্রদান করা, ৪. হজ্ব পালন করা এবং ৫. রমাদানের সিয়াম পালন করা। (বুখারী: ৮ ও মুসলিম)
হাদীসে ঈমানের পরিচয়
হাদীসে জিবরীল খ্যাত প্রসিদ্ধ হাদীসে ঈমানের পরিচয় দেয়া হয়েছে। একবার নবী সা. সাহাবীদের সামনে উপবিষ্ট ছিলেন। জিবরীল আ. মানুষের বেশে আগমন করে নবী সা. কে প্রশ্ন করেন, হে নবী, বলুন ‘ঈমান কী?’ উত্তর নবী সা. বলেন-
” أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكِتَابِهِ وَلِقَائِهِ وَرُسُلِهِ وَتُؤْمِنَ بِالْبَعْثِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ كُلِّهِ ”
‘ঈমান হলো-তুমি ুবিশ্বাস রাখবেন আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর কিতাবের প্রতি, (ক্বিয়ামতের দিন) তাঁর সাথে সাক্ষাতের প্রতি এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি। তুমি আরো বিশ্বাস রাখবে পুনরুত্থানের প্রতি এবং তাকদিরের উপর।’ [মুসলিম: ৭]
১. আল্লাহর প্রতি ঈমান:
মহান আল্লাহর প্রতি নিখাঁদ বিশ্বাস স্থাপন করা। তিনিই একমাত্র রব। তাঁর কোনো শরীক নেই। সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি তিনি। তিনি মহান ও একক। এই একত্ববাদের সাক্ষীকে পরিভাষায় তাওহীদ বলে।
তাওহীদকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। ১. তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ, ২. তাওহীদে উলুহিয়্যাহ, ৩. তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত।
প্রথম প্রকার: তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ- সৃষ্টি, কর্তৃত্ব, রাজত্ব ও পরিচালনার ব্যাপারে আল্লাহকে একক হিসেবে বিশ্বাস করার নাম তাওহিদে রুবুবিয়্যাহ। এ ব্যাপারে ইরশাদ করেন-
﴿ذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمۡ لَهُ ٱلۡمُلۡكُۚ وَٱلَّذِينَ تَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ مَا يَمۡلِكُونَ مِن قِطۡمِيرٍ﴾
‘তিনি আল্লাহ, তোমাদের রব, সমস্ত কর্তৃত্ব একমাত্র তাঁরই। তাঁর পরিবর্তে তোমরা যাদেরকে ডাকো, তারা খেজুর আঁটির পাতলা আবরণেরও মালিক নয়।’ (ফাতির: ১৩)
দ্বিতীয় প্রকার: তাওহিদে উলুহিয়্যাহ- এই কথার স্বীকৃতি দেয়া যে, একমাত্র আল্লাহ তা‘য়ালাই সত্যিকার মা‘বুদ বা উপাস্য। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। নিরঙ্কুশ ইবাদতের মালিকানা একমাত্র তাঁর। অন্য কেউ এতে শরীক নেই। এর নাম তাওহিদে উলুহিয়্যাহ। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন-
﴿وَإِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞۖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلرَّحۡمَٰنُ ٱلرَّحِيمُ ١٦٣﴾
‘আর তোমাদের উপাস্য একমাত্র আল্লাহ। তিনি ছাড়া অন্য কেউ উপাস্য নেই। তিনি মহা করুণাময় ও দয়ালু।’ (বাক্বারা: ১৬৩)
তৃতীয় প্রকার: তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত- এর অর্থ হলো, আল্লাহ তা‘য়ালা নিজেকে যে সমস্ত নামে নামকরণ করেছেন এবং পবিত্র কুরআন ও হাদীসে যে সকল গুণের কথা এসেছে সে সকল নাম ও গুণাবলির ব্যাপারে কোনোরকম পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও উপমা ব্যতীত আল্লাহ তা‘য়ালার জন্য একক ও অদ্বিতীয় হিসেবে সাব্যস্ত করে নেওয়া। আল্লাহ তায়ালার ৯৯টি সুন্দর নাম রয়েছে। সেগুলোতে বিশ্বাস রাখতে হবে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন,
﴿وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ وَذَرُواْ ٱلَّذِينَ يُلۡحِدُونَ فِيٓ أَسۡمَٰٓئِهِۦۚ سَيُجۡزَوۡنَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٨٠﴾
‘আর আল্লাহ তা‘য়ালার জন্য রয়েছে সুন্দর নামসমূহ। অতএব তোমরা তাঁকে সেসব নামেই ডাকো। আর তাদেরকে বর্জন করো যারা তাঁর নামে বিকৃত ঘটায়। তারা কৃতকর্মের ফল শীঘ্রই পাবে।’ (সুরা আ‘রাফ: ১৮০)
২. ফেরেশতাগণের প্রতি ঈমান
ফিরিশতাগণ আল্লাহ তা‘য়ালার সৃষ্ট নুরের তৈরি। তারা সর্বদা আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকে এবং তারা কখনো আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে না। তাদেরকে আনুগত্যের গুণ প্রদান করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ইরশাদ হচ্ছে,
﴿وَمَنۡ عِندَهُۥ لَا يَسۡتَكۡبِرُونَ عَنۡ عِبَادَتِهِۦ وَلَا يَسۡتَحۡسِرُونَ ١٩ يُسَبِّحُونَ ٱلَّيۡلَ وَٱلنَّهَارَ لَا يَفۡتُرُونَ ٢٠ ﴾ু
‘আর যারা তাঁর নিকটে (ফিরিশতাগণ) রয়েছে তাঁরা অহংকারবশত তাঁর ইবাদত করা থেকে বিমুখ হয় না এবং তারা ক্লান্তিও বোধ করে না। দিবারাত্র তারা মহান আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করে, (কখনো তাতে) শৈথিল্য করে না।’ (আম্বিয়া: ১৯-২৯)
৩. আল্লাহর কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান
পূর্বের সকল আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে সেসব মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এবং মহাসত্য। সর্বশেষ নাযিলকৃত পবিত্র কুরআন হলো পূর্বের সকল আসমানী গ্রন্থের সার নির্যাস ও পূর্বের বিধানসমূহকে রহিতকারী। তাই বর্তমান শুধু কুরআন অনুযায়ী আমল করতে হবে আর পূর্বের সকল কিতাবের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। আল্লাহ তা‘য়ালা ইরশাদ করেন,
﴿وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ بِٱلۡحَقِّ مُصَدِّقٗا لِّمَا بَيۡنَ يَدَيۡهِ مِنَ ٱلۡكِتَٰبِ وَمُهَيۡمِنًا عَلَيۡهِۖ﴾
‘আর আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি সত্য গ্রন্থ, যা পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর উপর প্রভাব বিস্তারকারী।’ (অর্থাৎ সত্য-মিথ্যা নির্ধারণকারী) [মায়িদাহ: ৪৮]
৪. রাসূলগণের প্রতি ঈমান
নতুন শরীয়ত নিয়ে যিনি আগমন করেন তাকে রাসূল বলে। সর্বপ্রথম রাসূল হলেন নূহ আ. এবং সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মাদ সা.। তাই পূর্বের সকল যুগে আসা নবীদের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। ইরশাদ হচ্ছে,
﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ﴾
‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এই বার্তা দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো।’ (নাহল: ৩৬)
৫. আখিরাতের প্রতি ঈমান
এর অর্থ হলো, হিসাব দিবসের প্রতি ঈমান রাখা। কিয়ামতের দিনে মানুষের যাবতীয় কর্মের উপর অবশ্যই হিসাব নেয়া হবে এবং কর্মের উপর অবশ্যই হিসাব নেয়া হবে।
﴿ ثُمَّ إِنَّكُمۡ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ تُبۡعَثُونَ ١٦﴾
‘তারপর কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে পুনর্জীবিত করা হবে।’ (মূ’মিনুন: ১৬)
৬. তাকদিরের প্রতি ঈমান
তাকদিনের ভালো ও মন্দের উভয় বিষয়ের প্রতি ঈমান রাখতে হবে। তাকদির আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই হয়। আদি থেকে অদ্য পর্যন্ত সবকিছুর ব্যাপারেই মহান আল্লাহ অবগত আছেন এবং যা কিছু ঘটেছে ও ঘটবে সবকিছু লাওহে মাহফুযে সংরক্ষিত রয়েছে।
﴿أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ مَا فِي ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِۚ إِنَّ ذَٰلِكَ فِي كِتَٰبٍۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٞ ٧٠﴾
‘তুমি কি জানো না, আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে আল্লাহ তা অবগত আছেন? নিশ্চয় তা একটি কিতাবে সংরক্ষিত আছে। তা আল্লাহর কাছে খুব সহজ।’ (সুরা হজ্ব: ৭০)
আল্লাহ তা‘য়ালা আমাদেরকে ঈমানকে বোঝার ও সঠিকভাবে লালন করার তৌফিক দিন এবং নেককাজের মাধ্যমে ঈমানকে মজবুত করুন। আমিন।