নারীদের চাকুরি, ব্যবসা, অনলাইনে ব্যবসা

নারীর কণ্ঠস্বর ও অনলাইন ব্যবসা: শরীয়তের দিকনির্দেশনা

নারীর কণ্ঠস্বর ও অনলাইন ব্যবসা: শরীয়তের দিকনির্দেশনা

ইসলাম মানুষের স্বভাব, সমাজের বাস্তবতা এবং নৈতিক নিরাপত্তাকে এক অনবদ্য ভারসাম্যে ধারণ করেছে। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য শালীনতা, নিরাপত্তা এবং সততার পরিবেশ রক্ষা করা এ ধর্মের অন্যতম মূলনীতি। সে প্রেক্ষিতেই নারীর কণ্ঠস্বর, পুরুষের সঙ্গে কথোপকথন এবং প্রয়োজনবশত উপার্জনে বের হওয়ার বিষয়ে শরিয়ত সুস্থ, বিবেকবান ও ভারসাম্যপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে।

নারীর কণ্ঠস্বর কি ‘সতর’?

ফিকহের গ্রহণযোগ্য মত অনুসারে নারীর কণ্ঠস্বর মূলত ‘সতর’-এর অন্তর্ভুক্ত নয়। অতএব প্রয়োজনের সময় নারীর পক্ষে পুরুষের সঙ্গে কথা বলা স্বভাবতই বৈধ। চিকিৎসা, সাক্ষ্য, কেনাবেচা বা প্রয়োজনীয় তথ্য বিনিময়—এসব ক্ষেত্রে কথোপকথন শরয়ি দৃষ্টিতে অনুমোদিত।

তবে ইসলাম কেবল বৈধতার পরিধিতে বিষয়টি সীমাবদ্ধ রাখেনি; বরং সম্ভাব্য ফিতনা ও নৈতিক অবক্ষয়ের দিকেও দৃষ্টি দিয়েছে। অনেক বৈধ কাজও সামাজিক বিবেচনা বা নৈতিক ঝুঁকির কারণে নিষিদ্ধ হয়ে যেতে পারে—এ নীতি ইসলামী আইনে সুপরিচিত। আমাদের সমাজে ফিতনার আশঙ্কা প্রবল হওয়ায়, অযথা বা অপ্রয়োজনে নারীর কণ্ঠস্বর নন-মাহরাম পুরুষদের সামনে প্রকাশ না করাই উত্তম ও সতর্কতাসম্পন্ন পথ।

নারীদের কথাবার্তায় সংযম—কুরআনের আদব

কুরআনে সূরা আহযাবের নির্দেশনা হৃদয়ের গভীরে আলোড়ন তোলে। সেখানে উম্মাহাতুল মু’মিনীন—যারা মানবসভ্যতার সর্বোচ্চ মর্যাদাধারিণী নারীগণ—তাদেরকেও বলা হয়েছে,

یٰنِسَآءَ النَّبِیِّ لَسۡتُنَّ کَاَحَدٍ مِّنَ النِّسَآءِ اِنِ اتَّقَیۡتُنَّ فَلَا تَخۡضَعۡنَ بِالۡقَوۡلِ فَیَطۡمَعَ الَّذِیۡ فِیۡ قَلۡبِہٖ مَرَضٌ وَّقُلۡنَ قَوۡلًا مَّعۡرُوۡفًا ۚ

হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে।—আল আহ্‌যাব – ৩২

এই আয়াত শুধু তাঁদের জন্য নয়; এটি সমগ্র নারীদের জন্য প্রযোজ্য
মুসলিম সমাজের নারীর জন্য এক নীতিগত আদর্শ। কথোপকথনে কোমলতা বা আকর্ষণীয়তা সৃষ্টি করা পুরুষের অন্তরে ভুল প্রবণতা জাগাতে পারে—এই আশঙ্কা থেকেই শরিয়ত সংযম ও দৃঢ়তার উপদেশ দিয়েছে। কথায় অযথা সৌন্দর্য, লজ্জাশীলতার বিপরীতে নরমতা বা সৌজন্যের অতিরিক্ততা—এগুলো সতর্কতার বিষয়।

এই আলোকে নারীর কণ্ঠস্বর রেকর্ড করে প্রকাশ্যে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা সাধারণত শরিয়তে কাম্য নয়; বিশেষত যখন এতে অপ্রয়োজনীয় শ্রোতাদের আকর্ষণ ও সম্ভাব্য ফিতনার ভয় থাকে।

উপার্জনের প্রসঙ্গে: দায়িত্ব কার?

ইসলামের স্পষ্ট বিধান হলো—নারীর সকল ভরণপোষণের দায়িত্ব তার বিয়ের আগে পিতার ওপর এবং বিবাহের পর স্বামীর ওপর। সন্তান সন্তুতি থাকলে তাদের উপর বর্তায়। ইসলাম নারীর অর্থনৈতিক বোঝা তার কাঁধে চাপিয়ে দেয় না; বরং তাকে মর্যাদার আবরণে রাখে।

তবে মানুষের জীবনে কখনো সংকট আসে,
জিম্মাদার ব্যক্তি অক্ষম হয়ে পড়ে, অথবা পরিবারের আর্থিক নিরাপত্তা ভেঙে যায়। কিংবা পরিবারে পুরুষ কেউ না থাকলে এমন বাস্তবতায় শরীয়ত নারীকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রাখে না; বরং প্রয়োজনীয় সীমার মধ্যে তাকে উপার্জনের অনুমতি দেয়। শর্ত হলো—

১. পরিবেশ যেন নিরাপদ হয়,
২. পর্দা ও শালীনতার বিধান রক্ষা করা হয়,
৩. এবং কোনো ধরনের ফিতনা বা অনৈতিকতার আশঙ্কা না থাকে।

যদি কোনো নারী কঠিন বাস্তবতায় পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে উপার্জনে বাধ্য হয়ে পড়েন, এবং তিনি নিজের অনলাইন ব্যবসায় পণ্যের বিবরণ রেকর্ড করা, তথ্য উপস্থাপন বা এ ধরনের কনটেন্ট তৈরি করেন—তাও আবার এমনভাবে যে, কণ্ঠে অপ্রয়োজনীয় কোমলতা বা আকর্ষণ সৃষ্টির কোনো প্রচেষ্টা নেই, বক্তব্য সংক্ষিপ্ত, পর্দাশীল ও প্রয়োজন সীমাবদ্ধ, এবং ফিতনা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাও নেই—
তাহলে শরঈ দৃষ্টিতে এ ধরনের কাজের সুযোগ রয়েছে।
অর্থাৎ নারীর নিজের অনলাইন বিজনেসে কণ্ঠ ব্যবহার—উপরোক্ত শর্তগুলো পূরণ হলে—জায়েয।

তবে লক্ষ্যণীয়, ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর মূল দায়িত্ব উপার্জন নয়, তবে প্রয়োজনে শরয়ী সীমা রক্ষা করে সে এতে অংশ নিতে পারে। [Jamia Binoria Aalamia, Fatwa No: 50592]

রেফারেন্সসমূহ:
সূরা আহযাব (৩৩) : ৩২;
দুররে মুখতার ৩/৫৭২,
মারাকিল ফালাহ ২৪২ পৃ. আলবাহরুর রায়েক ১/২৭০;
শরহু মুখতাসারিত তহাবী ১/৫৬৩;
রদ্দুল মুহতার ১/৪০৬,

Facebook
Twitter
LinkedIn

সম্পর্কিত পোস্ট